নদী

পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণশক্তির টানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ফিতাকারে নেমে আসা বিপুল জলরাশিকে নদী বলা হয় নদীর থাকে উৎস, যেখান থেকে জলরাশি বইতে শুরু করে পার্বতীয় বৃষ্টি বা বরফগলা জল হতে পারে নদীজলের উৎস তা ছাড়া নদীর থাকে মোহনা, যেখানে নদী সাগরে মেশে

নদী এক বিস্ময়কর ব্যাপার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস তাঁর ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসে বলেছেন — নদী তার উৎসে, পর্বতশিখরে, জলপ্রপাতে, জলস্রোতে, মোহনায়, সর্বত্র একই সময় বর্তমান নদী তাই ক্রিয়াকালহীন তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যুগপৎ ঘটমান  ব্লক ইউনিভার্স তত্ত্ব অনুসারে মানুষের জীবনও ক্রিয়াকালহীন তার জীবনকালের সমস্ত ঘটনাবলী একই সময় সংঘটিত হয়ে একই সঙ্গে বিদ্যমান থাকে ব্লক-মহাবিশ্বের চতুর্মাত্রিক স্থানকালিক ধাত্রে

তা সত্ত্বেও, যে-জল নদীতে প্রবাহিত হয় তা কখনও এক জল নয় নদীর জল সদা বহমান, সদা পরিবর্তনশীল; কখনওই স্থির নয় সে কারণেই গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, ‘কেউ একই নদীতে দুই বার নামতে পারে না’ কারণ তখন সে-নদী আর আগের নদী নয়, নতুন জলে নতুন নদী

নদীর জলের মূল উৎস সাগরে জল সাগরে জল সূর্যের স্পর্শে বাস্প হয়বাস্প আকাশের স্পর্শে মেঘ হয়পর্বতের স্পর্শে মেঘ থেকে ঝরে বৃষ্টি। মাটির স্পর্শে বৃষ্টি হয় নদী। শুরু হয় নদীর পথচলা, যে-পথ শেষ হয় সাগরে। সেখানে নদী তার নাম-পরিচয় হারিয়ে বিলীন হয় উৎসে। অর্থাৎ নদী সাগর থেকে উৎপন্ন হয়ে পুনরায় সাগরে গিয়ে সাগর হয় এবং সাগরে নামে পরিচিত হয়

সাগরজলের সঙ্গে পাহাড়ি জলের মিলনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই সৃষ্টি হয় নদীর দীর্ঘ চলার পথে অনেক স্মৃতি বহন করে নদী সাগরেরও থাকে অনেক স্মৃতি যখন নদী আর সাগরের দেখা হয় তখন তাদের অনেক গল্প থাকে পরস্পরকে বলার গল্প বলা শেষ হলে নদী আবার মেঘ হয়ে ফিরে যায় পর্বতে

river
     
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ নদীকে ‘জলাঙ্গী’ নামে অভিহিত করেছেন — ‘আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায় এখানে জলাঙ্গী মানে ‘জল যার অঙ্গে’ নদী আসলে জলের মূর্তি

মানব দেহের সিংহভাগই তো জল তাই মানুষও নদীর মতো জলাঙ্গী — জলের মূর্তি  তা হলে, আমিও কি জলের মূর্তি? তুমিও কি জলের মূর্তি? হ্যাঁ, আমরা সবাই জলের মূর্তি — নদীর মতো জলাঙ্গী তা হলে কেন হত্যা করতে চাও আমাকে জলে গড়া এ দেহ তো আপনি ভেঙে পড়বে বর্ষার জলে

নদীর মতো আমি আপন বেগে পাগল-পারা আমার চলার পথে প্রতিবন্ধ পড়লে আমি নদীর মতো অন্য পথে চলি, প্রতিবন্ধক সরানো আমার কাজ নয় কিন্তু কেউ যদি আমাতে বাঁধ দিতে চায়, আমার আবেগকে সংযত করতে চায় অথবা তারা যে-দিকে চায় সে-দিকে বইতে বলে, আমি দুর্বার হয়ে উঠি

আমাদের শিরা ও ধমনিতে প্রবাহিত হয় নদী সে নদীর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিন্ড বা হৃদয় তাই একে বলা হয় হৃদয়ের নদী হৃদয়ের নদী দুটি; একটি প্রবাহিত হয় শিরায়, আর একটি প্রবাহিত হয় ধমনিতে হৃদয়ের নদী আছে বলেই আমরা বাঁচি ‘দুই হৃদয়ের নদী’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: 

দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি
বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়
সম্মুখে রয়েছে তার   তুমি প্রেমপারাবার,
তোমারি অনন্তহৃদে দুটিতে মিলাতে চায়
সেই এক আশা করি দুইজনে মিলিয়াছে,
সেই এক লক্ষ্য ধরি দুইজনে চলিয়াছে
পথে বাধা শত শত, পাষণ পর্বত কত,
দুই বলে এক হয়ে ভাঙিয়া ফেলিবে তায়
অবশেষে জীবনের মহাযাত্রা ফুরাইলে
তোমারি স্নেহের কোলে   যেন গো আশ্রয় মিলে,
দুটি হৃদয়ের সুখ   দুটি হৃদয়ের দুখ
দুটি হৃদয়ের আশা মিলায় তোমার পায়

 দুই হৃদয়ের নদী চলেছে এক লক্ষ্যে অনন্তহৃদে মিলিবে অবশেষে তেমনই জীবনের মহাযাত্রা ফুরালে মানুষও নদীর মতো নাম-পরিচয় পদ-পদবি হারিয়ে বিলীন হয় উসে; তার দেহ মিশে মৃত্তিকায় আর আত্মা লীন হয় পরমাত্মায়। 


✍অসীম দে
গুয়েল্ফ, অন্টারিও, কানাডা

Popular posts from this blog

শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ চেনার উপায়

সীমার মাঝে অসীমের প্রকাশ — সৃষ্টিতত্ত্বের মূলভাব

অমাবস্যা ও পূর্ণিমা — চন্দ্রসূর্যের মিলন ও বিরহ তিথি

তেল মাহাত্ম্য

ঈশ্বর, প্রকৃতি ও রবীন্দ্রনাথ

রাসলীলা মাহাত্ম্য

আঁধারের রূপ ও বিপন্ন অন্ধকার

আধ্যাত্মিকতা — পাশ্চাত্য ভাবধারার আলোকে

সূর্য উপাসনা

হৃদয়-দর্পনে দেখা